প্রকাশিত: Sat, Feb 11, 2023 6:36 AM
আপডেট: Fri, Jun 27, 2025 8:00 AM

‘পাঠান’, বাঙালি ও সিনেমার দুনিয়া

আফসান চৌধুরী : [২] চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির প্রধান উপদেষ্টা সুদীপ্ত কুমার দাস ‘সাফটা’ চুক্তির আওতায় শাহরুখ খানের সদ্য মুক্তি পাওয়া ‘পাঠান’ বাংলাদেশে মুক্তি দেওয়ার কথা বলেন। সিনেমা হল মালিকরা নিশ্চয় চান এই ছবিটা প্রদর্শিত হোক। শাহরুখ খান নিজেও ব্যবসা করার জন্যই ছবিটা বানিয়েছেন। অতএব দেখানোর ইচ্ছা থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এর মধ্যে আপত্তি তুলেছে বিশেষ করে শিল্পী-পরিচালকবৃন্দ। তাদের মধ্যে নির্মাতা দেলোয়ার জাহান ঝন্টু অন্যতম। তার কথা হচ্ছে, এর ফলে হিন্দির সাথে সাথে উর্দুও ঢুকে যাবে। দর্শকের চাহিদার চেয়ে ভাষাপ্রেম ইত্যাদি বড়। বলেছেন, কেউ না এলে তিনি একাই ‘পাঠান’ মুক্তির বিরোধিতা করে হলের সামনে নামবেন। ভাষার প্রশ্নে আপোস করবেন না তিনি। বেশ আন্দোলন আন্দোলন গন্ধ বুনেছেন তিনি।

[৩] ঝন্টুর সব কথা সবাই সিরিয়াসলি নিয়েছে তা নয়। নিশ্চয়ই তিনি একজন দেশপ্রেমিক কিন্তু অনেকের মতে তিনিও অর্থনীতির অবস্থান থেকে বলছেন এসব কথা। ধরে নেওয়া যেতে পারে দ্বন্দ্বটা লাভ লোকসান নিয়েও আছে। বেশ কিছুকাল ধরে যেসব ছবি হয়েছে তা ভালো লাভ করছে না দুই একটা ছাড়া। হলের আকাল নতুন কথা নয়। যদিও ‘হাওয়া’, ‘পরাণ’ ও কয়েকটি নয়া জামানার ছবি ব্যবসা সফল, সেগুলো ঝন্টুর প্রজন্মের তৈরি নয়। সিনেমা দেখা এখনো বেগবান হয়নি। ইন্ডাস্ট্রি/শিল্প কেবল দেশপ্রেম নয় বাণিজ্যের বিষয় সব শিল্পের মতো।

[৪] ঝন্টুর কথা তো শোনা গেল, কিন্তু অন্যপক্ষে আছে হল মালিকরা, যারাও এই বিতর্কের অংশীদার। দেশের সিনেমা হলগুলোর মালিকরা দীর্ঘদিন ধরেই ভারতীয় সিনেমা দেখানোর তদবির করে আসছে। তথ্যমন্ত্রী বলছেন, চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো সম্মত হলে সরকারের আপত্তি নেই।

মন্ত্রী, হাসান মাহমুদ বলেছেন যে, সংশ্লিষ্টদের লিখিত আবেদন পেলে ভারতীয় সিনেমা আমদানি ও দেশের হলগুলোতে প্রদর্শন করা সম্ভব। যদি আবেদন জমা পড়ে, বছরে ১০টি হিন্দি চলচ্চিত্র আমদানির ব্যবস্থা নেবে সরকার। কিন্তু সমস্যাটা হলো, ৪ সমিতি। চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতি, পরিচালক সমিতি, শিল্পী সমিতি ও প্রযোজক সমিতি। হাসান মাহমুদ বলেছেন, আমদানি বেশির ভাগ সমিতি চায় কিন্তু শিল্পী সমিতি চায় না। স্বাভাবিকভাবেই, সরকার কাউকে নাখোশ করতে চায় না। বিশেষ করে শিল্পীদের, যাদের আবার পাবলিক প্রোফাইল আছে এবং মাঝে মধ্যে রাজনীতি সমর্থন আদায়ের কাজে লাগানো যায়।

[৫] সরকার এক হাজার কোটি টাকার স্বল্প সুদে ঋণ তহবিল গঠন করেছে এবং ৫০-এর অধিক দরখাস্ত পড়েছে এই ঋণের জন্য। কিন্তু ঋণ এক বিষয় আর এই খাতের উন্নয়ন অন্য বিষয়। সিনেমা ব্যবসার বাস্তবতা কি? সিঙ্গেল হল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আর আসছে সিনেপ্লেক্স। যে ঋণের কথা বলা হচ্ছে, সেটা মাল্টিপ্লেক্স ও সিনেপ্লেক্স করার জন্য। অর্থাৎ সরকার জানে আগামীর চেহারা কেমন। হল মালিকদের কথা হলো, হিন্দি সিনেমা আসলে ১) সিনেমা হল বৃদ্ধি পাবে, ২) নতুন নতুন সিনেপ্লেক্স হয়ে ৪০০/৫০০ স্ক্রিন হবে, আর ৪০০ স্ক্রিন হলে দেশের প্রযোজকরা বিগ বাজেটের সিনেমা করতে পারবে। যা ভারতের সিনেমার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় যেতে পারবে। তাছাড়া দেশের তরুণ পরিচালকবৃন্দ এ যুগের প্রজন্মের জন্য সিনেমা বানাতে পারবে। ফলে অনেক লোকের কর্মসংস্থান হবে। বিশেষ করে শিক্ষিত যুবক শ্রেণি।

[৬] বাস্তবতার কথা হচ্ছে আমদানি বন্ধ করে লাভ কি? কারণ সিনেমা তো দেখতেই পায় এভাবে, সেভাবে, যে ভাবেই হোক! তাছাড়া ক্ষতির প্রমাণ কি? টিভি, মোবাইল, ওটিটি যেখানে হিন্দি দেখাচ্ছে সারাক্ষণ তখন হলে না দেখানোর যুক্তি কি? তাছাড়া এর পরও দেশি সিনেমার প্রতি আগ্রহ কমেনি। ‘হাওয়া’ বা ‘পরাণ’ চলল কি করে?

[৭] সিনেপ্লেক্স নয়া কালের কারখানার শো-কেস, আর নয়া নির্মাতারাও উপস্থিত। এটা অস্বীকার করে লাভ নেই। অর্থাৎ এটা ক্রান্তিকাল। নয়া সিনেমা হল, নয়া সিনেমা, নয়া নির্মাতা, বড় কথা নয়া দর্শক। কারো পছন্দ হোক আর না হোক পরিবর্তন হবেই। সরকার এই পরিকল্পনা আর সমন্বয় কেন করছে না, সেটা তারাই বলতে পারবে। সময়টা ‘পাঠান’, বাঙালির বিষয় নয়, অর্থনীতি আর চাহিদার।

 লেখক, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক